বলশেভিক বিপ্লবের মহানায়ক ভ্লাদিমির লেনিন বলেছেন- "দু'পা আগাতে হলে প্রয়োজনে এক পা পিছাতে হয়"। ট্রয়ের যুদ্ধের প্রথম দিনে ট্রোজান সেনাদের মুহূর্মুহু আক্রমণে একিয় সেনারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পরলে রাজা আগামেমনন তাঁর সেনাদের শিবিরে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। পুনরায় সংগঠিত হয়ে উপযুক্ত সময়ে ট্রয় নগরী জিতে নিয়েছিলেন রাজা আগামেমনন।
রাজনীতিতে থেমে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া নয়। থেমে যাওয়া মানে নতুন করে যুদ্ধ জয়ের কৌশল মাত্র। রাজনৈতিক খেলার রূপ-রং ও কৌশল সতত পরিবর্তনশীল। আর রাজনীতির রঙ পরিবর্তন করতে না পারলে,প্রয়োজনে নিজেদের রঙ পরিবর্তন করে হলেও রাজনীতিতে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে ২০১৪ ও ১৫ সালের ৫ জানুয়ারির আগে-পরে প্রায় তিন মাস করে সারাদেশ অচল করে দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু সরকারের নজিরবিহীন নির্দয় দমন-পীড়ন ও দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারনে সেই গণআন্দোলন দুটি চুড়ান্ত সফলতার মুখ দেখেনি। সরকার ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ক্যাডারদের দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে হামলা করতেও কসূর করেনি। সরকারের নানা মহল থেকে বিএনপিকে পুনরায় আন্দোলনের জন্য উসকানিমূলক বক্তব্য-বিবৃতি দিলেও বিএনপি তাদের কর্মকৌশল পরিবর্তন করে ধীরে চলা নীতি গ্রহন করেন। তাই এই সময়ে বক্তব্য-বিবৃতিতে মাঠ গরম না করে সংগঠন পূণর্গঠন ও গণসম্পৃক্ততার দিকেই নজর দেন বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর দল।
কাউন্সিলের মাধ্যমে দল পূণর্গঠন করে অবকাশ ও শক্তি সঞ্চয়ের সাথে সাথে গণমূখী কর্মপরিকল্পনায় হাত দেয় বিএনপি। কাউন্সিলের পর প্রথমে দলের নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করেন বেগম খালেদা জিয়া। এরপর একে একে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল, মহিলাদল, জাসাস, ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম মহানগর সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কমিটি পূণর্গঠনের মাধ্যমে দলকে নতুন আঙ্গিকে সাঁজান বেগম খালেদা জিয়া। এছাড়া এ সময়ে বিএনপির সাথে সাথে ছাত্রদল-যুবদল-স্বেচ্ছাসেবক দল তাদের জেলা কমিটিগুলো পূণর্গঠনের কাজ সম্পন্ন করায় মনোনিবেশ করে। ৭৫-৮০ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। জেলা কমিটিসমূহ ইতিমধ্যে থানা,পৌর ও ইউনিয়ন কমিটিগুলোকে ঢেলে সাজাচ্ছেন। তৃণমূল থেকে তথ্য নিয়ে দলের হাইকমান্ডের সমন্বয়ে এই সময়ে দলটিকে বেশ কিছু পরিকল্পিত কর্মসূচি প্রণয়ন ও তার সফল বাস্তবায়ন করতে দেখা যায়। নবীনের শক্তি আর প্রবীনের কল্পনায় ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে বছর জুড়েই দলটি তৃণমূল পর্যায়ে মাঠ চষিয়ে বেড়িয়েছেন।
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধগতিতে সরকারের ব্যর্থতা ও নিজেদের সরকারের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে,"বাজারে আগুন,জনজীবন বিপর্যস্ত"- শিরোনামে একটি পোষ্টার দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয় বিএনপি। দেশে গণতন্ত্রহীন সংস্কৃতি, সরকারের অপশাসন ও অন্যায়-অত্যাচার তুলে ধরে বেগম খালেদা জিয়ার নাগরিক সচেতনতামূলক একটি গণচিঠি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছে দলটি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্রলীগ কর্তৃক একচেটিয়া দখল, নানা অনিয়ম, শিক্ষার মান ও আগামীর ছাত্রদলের লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে তার ২৫ দফা আহবান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশব্যাপী সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে দেখা যায়।
শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্যের সমন্বয়ে একটি গণমূখী আন্দোলনের লক্ষ্যে সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি ও শ্রমিক কর্মচারীদের প্রতি সরকারের ক্রমাগত অমানবিক অবহেলা তুলে ধরে জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদলের একটি যৌক্তিক আহবান সারাদেশের সরকারী,আধা-সরকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক কর্মচারীদের হাতে হাতে পৌঁছে দেয় শ্রমিকদল। এই সময়ে বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর জেলা পর্যায়ের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা স্বহস্তে পোষ্টার লাগানো ও লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের উৎসাহিত করতে দেখা যায়।
জাতীয় গণমাধ্যমগুলো সরকারের নিয়ণ্ত্রণে থাকলেও স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বেশ গুরুত্বের সাথেই এইসব জনসম্পৃক্ত কর্মসূচীগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রচার করে। জাতীয় গণমাধ্যমগুলোর সাথে সাথে প্রায় প্রতিটি জেলাতেই স্থানীয় জনপ্রিয় গণমাধ্যম রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ের জনমত প্রভাবে এই গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই সুযোগটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন বিএনপি ও তার নীতি নির্ধারকরা। বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলাদল এবং জাসাসের প্রায় সকল পর্যায়ের কমিটি পূণর্গঠন ও দলীয় নানা কর্মসূচিগুলোতে নেতা-কর্মীদের প্রানচাঞ্চ্যলতা ছিলো চোখে পরার মত। সরকারের গুম-খুন,মামলা-হামলাকে উপেক্ষা করে বিএনপি নেতা-কর্মীরা আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের উপর সরকারের অত্যাচার ও নিপীড়ন বিএনপি নেতাকর্মীদের মানসিক শক্তি ও উদ্যম বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়ে পুনরায় সুসংগঠিত হতে সহায়তা করেছে বলে জানা যায়।
বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত "ভিশন-২০৩০" জনমনে বেশ আশার সঞ্চার করেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বেগম জিয়া নানা সময়ে তাঁর বক্তব্য-বিবৃতিতে দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করলেও আগামীর শাসন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা,জবাবদিহিতা ও স্বপ্নিল বাংলাদেশের রূপরেখা সুস্পষ্টভাবে জাতির সামনে তুলে ধরে তিনি ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন বলে একাধিক জনমত জরিপেও উঠে এসেছে। দলটি তার ভিশনের ১০ লক্ষাধিক কপি ইতিমধ্যেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা যায়। নানা সভা-সেমিনারের মাধ্যমে দলটি তার ভিশন-২০৩০ কে সৃষ্টির মাইলফলক হিসেবে তুলে ধরে এর বাস্তবায়নে জনসহযোগিতা আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি বিএনপি ১ কোটি লক্ষ্যমাত্রায় নতুন সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচি হাতে নেয়। দেশের মধ্যে যেমন,তেমনি দেশের বাইরে প্রবাসীদের মাঝেও বিএনপির সদস্য ফরম পূরণের আগ্রহ নিয়মিত চোখে পরার মত। ইতিমধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ ফরম পূরণ কার্য সম্পন্ন হয়েছে বলে বিএনপির দপ্তর বিভাগ নিশ্চিত করেছে। সদস্য সংগ্রহ অভিযান তাদের লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশাবাদী দলটি। অতিসম্প্রতি সর্বনাশা বন্যার করাল গ্রাসে সর্বহারা উত্তরাঞ্চলের বানভাসী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলো। দলের মহাসচিবের নেতৃত্বে উত্তরাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি থানা ও ইউনিয়নে ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। বেগম খালেদা জিয়া তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করলেও নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখার পাশাপাশি দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়।
বিএনপি তার একাধিক সার্ভে টিমের মাধ্যমে খোঁজ-খবর নিয়ে জনগণের দাবি ও মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে চলেছেন বলে জানা গেছে। প্রায় দশ বছরব্যাপী সরকারের অবর্ণনীয় জুলুম ও নির্যাতনে বিএনপি নেতা কর্মীদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে বলে তারা জানিয়েছেন। সরকার পতন ছাড়া বেঁচে থাকার ন্যূনতম অবলম্বনও আর তাদের হাতে নেই বলে জানিয়েছেন কর্মীরা। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সাথে সাথে দেশীয় একটি বলয় দেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তাই দলীয় আভ্যন্তরীণ শক্তিকে জাগ্রত করার মাধ্যমে জনগনকে সাথে নিয়ে সরকার বিরোধী গণআন্দোলনে পুনরায় মাঠে নামার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে বিএনপি। এই লক্ষ্য পূরণে ইতিমধ্যে তারা অনেকটাই সফলতার পথে হাঁটছেন বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে।
বারবার বিভিন্ন কূট-কৌশল করে সরকার বিএনপিকে পুনরায় আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছে। কিন্তু দলটি সরকারের পাতা ফাঁদ এড়িয়ে,তার উদ্দেশ্য সাধনে লক্ষ্চ্যূত না হয়ে যথেষ্ট ধৈর্য্য ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বোদ্ধারা মনে করেন। এ সময়ে বিএনপির বিভিন্ন গণমূখী কর্মসূচিগুলোও তাদের নজরে ছিল বলে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন। কর্মসূচিগুলোকে সার্বিক রাজনীতিতে একটা পরিবর্তনের আভাস হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। বোদ্ধাদের কেউ কেউ আবার গণধারার এই কর্মসূচিগুলোকে বেগম জিয়া ঘোষিত ভিশন-২০৩০ এর জনাস্থা অর্জনে প্রাথমিক সোপান হিসেবে দেখছেন।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ভিন্ন ছক থাকলেও গণতান্ত্রিক দল হিসেবে একটি নব্য স্বৈরশাসকের বিপক্ষে সঠিক পথেই হাঁটছে বিএনপি-এমটাই অভিমত রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বোদ্ধাদের। বিশ্লেষকদের বদ্ধমূল ধারণা,এই ছকে এগুতে থাকলে অচিরেই সকল ষড়যন্ত্র আর বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে,জনগণের ভোটের মাধ্যমেই বিএনপি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
No comments:
Post a Comment